ফিরে দেখা ২০২৪
বছরের শুরুতে কোনঠাসা, শেষে ক্ষমতার কাছাকাছি বিএনপি
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
৩০-১২-২০২৪ ০৯:১০:২২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
৩১-১২-২০২৪ ১১:৫৪:৪১ পূর্বাহ্ন
সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের শুরুতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। কিন্তু বছরের শেষে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফসল হাতে পেয়েছে দলটি। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে দেশ গঠনের কাজে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
দলটির এই দীর্ঘ লড়াইয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। বারবার হতে হয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে লড়তে হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। স্রোতের প্রতিকূলে নেতাকর্মীরাও বিভিন্ন সময় হয়েছেন জেলে বন্দী। এছাড়াও অনেকে হয়েছেন বাড়ি ছাড়া ও দেশান্তরি। তবে এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হয় ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে পতিত স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। মূলত এরপর থেকেই ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ফুরফুরে অবস্থানে রয়েছে বিএনপি।
বর্তমানে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপির নেতারা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সভা-সমাবেশ করছে দলটি। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে কোণঠাসা হয়ে পড়া দলটির পালে হাওয়া লেগেছে। তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে মাঠের রাজনীতিতে। তবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে দলটির সামনে এখনও রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এখন সংগঠন গুছিয়ে নিয়ে এসে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তবে বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফার রূপরেখা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।
দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে। পরে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শর্ত-সাপেক্ষে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তারপর বিভিন্ন সময় তাঁর মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও, শর্ত অনুযায়ী তাঁকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। প্রায় সাত বছর পর গত ৭ আগস্ট বিএনপির জনসভায় খালেদা জিয়ার ভিডিও রেকর্ডিং বক্তব্য প্রচার করা হয়। আর এক যুগ পর গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সশস্ত্র বাহিনী দিবসে যোগ দেন তিনি। এইদিকে চলতি মাসের ২৫ তারিখ খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আবদুস সাত্তার জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য আগামী ৭ জানুয়ারি লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে।
২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে তারেক রহমানের বক্তব্য বা বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি রিট করেন আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে তিনি পলাতক আসামি। পরের দিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। এতে তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য ও বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এই আদেশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়াও ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট এক আদেশে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বক্তব্য, বিবৃতি, অডিও ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের কিছুক্ষণ পর গণমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের বক্তব্য ও ভিডিও প্রচার শুরু করে। ফলে, প্রায় ১০ বছর পর গণমাধ্যমে ফিরে আসেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মির্জা ফখরুল ও আমীর খসরুকে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের কর্মসূচির পরপর গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান তারা। প্রায় সাড়ে তিন মাস কারাগারে তারা বন্দি ছিলেন। এছাড়া নানা অভিযোগ গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, শাহজাহান ওমর, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ শীর্ষস্থানীয় সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের হয়।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির ৩৫ সিনিয়র নেতাকে কারাগারে বন্দী রাখা হয়। এছাড়াও মধ্যম সারি ও তৃণমূলের অন্তত ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপি দেশবাসীকে নির্বাচনের ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ৬ জানুয়ারি ভোর ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করে। এরপর ১১ জানুয়ারি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে দীর্ঘ ৭৫ দিন বন্ধ থাকার পর মূল ফটকের তালা ভেঙে প্রবেশ করেন বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
চলতি বছর মার্চ মাসে ভারতীয় পণ্য বয়কট বা ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযানে সমর্থন দেয় বিএনপি। এছাড়া এই কর্মসূচিতে ৬৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটও সমর্থন দেয়। মূলত, বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে- এমন অভিযোগে নির্বাচন পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বয়কট বা ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা।
গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বিএনপি ভাঙার তৎপরতা ছিল। তাতে কোনো মহলই সফল হয়নি। নানা চাপ ও প্রলোভন থাকার পরও ‘দল ভাঙার প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা যায়নি। দল ভাঙার তৎপরতার অংশ হিসাবে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার, মামলা এবং কয়েক শ নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়। নেতাদের ভোটে নিতে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপি নামে কিংস পার্টি গঠন করা করা। এতেও সারা মেলেনি। শুধু ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, একরামুজ্জামান ও শাহ আবু জাফর ছাড়া আর কাউকে দল থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। তখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপির জন্য এটিই বড় ধরনের সাফল্য ছিল।
গত ৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দেয় বিএনপি। পরে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরম তৈরি করেন। একের পর এক কর্মসূচি দেন। আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয় বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারা দেশ যখন উত্তাল, তখন সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক আসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনে সবস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অংশ নেওয়ার নির্দেশনা দেন। ৪ আগস্ট ছাত্ররা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালন করে। সেদিন ছিল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ওইদিন বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মাঠে থেকে বড় ভূমিকা পালন করেন।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তারেক রহমানের দূরদর্শিতা, নানা দিকনির্দেশনা, বক্তব্য, ইতিবাচক মানসিকতা, সহনশীলতা, ধৈর্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাধারণ মানুষসহ সব মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কঠোর নির্দেশনা, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং প্রতিহিংসার পরিবর্তে সহনশীল রাজনীতির কারণে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে সারাদেশে। সে সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীশূন্য দেশে পাড়া-মহল্লায় পাহারা দিয়েছেন নেতাকর্মীরা। এছাড়া তারেক রহমানের দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন রকম এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি। আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তাবনা ও দলীয় নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় জামায়াতে ইসলামীসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সম্ভাব্য নতুন দলের মুখোমুখি হতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপিকে অন্তর্র্বতী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে হবে দেশকে।
বাংলা স্কুপ/এএইচ/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স